পাতাঝরা দিনের সাতকাহন...

সোমবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৫ ৫:৩৫ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
১. আমিও উঠে এসেছি দুর্গন্ধ পুঁতিময় অন্ধকার ফুঁড়ে
কস্টের কথাগুলো কেউ লিখতে চায় না। কেন যেন সঙ্গোপনে এড়িয়ে যায়।
পকেটে পয়সা নেই, আধপেটা খাওয়া, ভাগাভাগিতে সিগারেট ও চা, উস্কোখুশকো চুল, দুইদিনের না কামানো দাঁড়ি, বর্তমান ও ভবিষত্যের দু:শ্চিন্তায় চোখের নীচে কালি, হাঁটতে হাঁটতে পায়ের সেন্ডেলের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, শার্টের বোতাম একটি ছেঁড়া, শার্টের কলারে ঘাম-ময়লায় কালশীটে দাগ পড়ে গেছে, ময়লা একটা প্যান্ট সাপ্তাহে দু'বার কেচে পড়া। কোকড়াচুলে কতদিন তেল সাবান পড়েনি।
এমনও দিন গেছে অনেকের যৌবনে, তারুন্যে। কিন্তু পরবর্তী জীবনের সাফল্যে সব ভুলে গিয়ে বর্তমানের চাকচিক্যে ডুবে থাকা মানুষগুলো কখনো কোথাও বলে না, " আমিও উঠে এসেছি দুর্গন্ধ, পুঁতিময় অন্ধকার ফুঁড়ে। "
মানুষ ভুলে যায় নিজের একাকী লড়াই সংগ্রামের কথা, যে গল্পে লজ্জা নেই,আছে অনুকরনীয় দৃস্টান্ত, আছে মাহত্ব্য।
এখনকার সময়ের মানুষ বড় হিপোক্রেট, ভন্ড। সবকিছু লুকোতে পছন্দ করে। পাছে যদি কেউ অবজ্ঞা করে!
২. জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা...
বড় আজব এ কোলাহলময় নাগরিক জীবন। সমাজের কথিত স্ট্যাটাস না থাকলে কারো কারো জাত থাকে না ! তাই উপরে ওঠার সিঁড়ি ডিঙ্গাতে গলদঘর্ম হচ্ছে একেকজন মানুষ। শুধু দেখে অন্যের তরতর করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া । পরশ্রীকাতরতায় ভুগতে থাকা চোখ দু'টো কি কেবলই ঈর্ষায় টাটায়?
যদি নিজে ওখানটায় না পৌঁছাতে পারি সমাজে কি করে চলি, এ ভাবনায় প্রতিদিন ভেতরে ভেতরে খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষগুলো। স্ত্রী, সন্তানরা প্রতিনিয়ত এটা সেটা কত কিছু চাইছে। বায়না - আবদার মেটাতে সংসারের মানুষটা যে যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে সে খেয়াল কারো নেই।
মধ্যবিত্তের চাকুরীজীবির উপার্জনটা সীমিত। একটু উপরি আয়ের জন্য দিবানিশি ছুঁটতে থাকা মানুষগুলো কখন যে অসৎ পথে পা বাড়িয়েছে তা জানেন শুধু অন্তর্যামী।
৩. মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল...
এই যে এতো কিছু চাই চাই চাই , সব পেলেই কি শান্তি মিলছে?
মিলছে কি অমরত্ব?
একবারও ভেবেছি কি, ভোগই জীবন নাকি ত্যাগেই সুখ! এতো সম্পদ, ঐশ্বর্য্য, ভোগ ও সুখ নিয়ে দম্ভ করার কিছু নেই। জীবনের চলমান চাকা মুহুর্তেই থেমে যেতে পারে। যে সাইকেলে আপনি চড়ে আছেন তার হাওয়া যখন তখন নি:শেষ হতে পারে। সবকিছু থেকে নিমিষেই নাই হয়ে যাবেন। কিছুই নিয়ে যেতে পারবেন না। কারন একটাই কাফনের কাপড়ে পকেট থাকে না। উড়ে যাওয়া পাখির মতন পালক পড়ে থাকবে। আশেপাশে ঘিরে থাকা লোকজন সাময়িক বিলাপ, কান্না হয়ত করবে কিন্তু আপনাকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারবে না শানশওকতের মাঝে।
৪. প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ..
মানুষ দিন দিন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। একান্নবর্তী যৌথ পরিবার ভেঙে সন্তান সন্ততি নিয়ে ছোট পরিবার, ছোট পরিবার থেকে শুধুই স্বামী-স্ত্রী দু'জনের পরিবারও এখন হরহামেশা চোখে পড়ে। পশ্চিমা বিশ্বের মতন সন্তান সন্ততি নিতেও আপত্তি। কারন শুধু আত্মকেন্দ্রিকতা নয় , নাগরিক জীবনের রুঢ় বাস্তবতায় বেঁচে থাকার সংগ্রামে সবাই হিমশিম খাচ্ছে। উপরে ওঠার সিড়িঁ খুঁজতে গিয়ে প্রায় সবাই ইঁদুর দৌড়ে ছিটকে পড়ছে। যে যত বেশী অন্যায়কে সর্মথন, প্রশ্রয় দিতে পারছে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক বলয়ের আশেপাশে থাকতে পারছে, অনৈতিক সুবিধা পেয়ে সেই এখন সবচেয়ে ভাল আছে।
অথচ এরাই একদিন আর্দশলিপি, ঈশপের নীতিকথা পড়ে বড় হয়েছে। শিশুপাঠ্যে পড়া 'সদা সত্য কথা বলিবে, সৎ সঙ্গ স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ' - এসব নীতি নৈতিকতার বাক্যগুলোকে শুধুই বুলি মনে করে। এখন প্রায় মানুষই এগুলো মনে রাখেনি।
বলছিলাম, মানুষ দিন দিন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নিজের বাহিরে কিছুই চিন্তা করতে পারে না। কিভাবে বেঁচে থাকা যায়, কিভাবে দু'টো পয়সা বেশী আয় করা যায়, ক্যারিয়ারের গ্রাফটা উর্ধ্বমুখী করা যায়-সেদিকে তাদের মনোনিবেশ ও দৌড়ঝাঁপ বেশী। নাগরিক জীবনে তারা এতোটাই আত্মকেন্দ্রিক যে, পাড়া পড়শী দুরে থাক, নিজের পরিবার স্বজনদেরও চিনতে চাইছে না বা কথিত সামাজিক স্ট্যাটাসগত সমস্যায় ভুগতে থাকায় মিশতেও পারছে না।
বিদ্যমান আর্থ সামাজিক কাঠামো ও এর শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষকে শুরু থেকে শিখিয়েছে ' 'আপনি বাঁচলে বাপের নাম কিংবা চাচা আপনা প্রান বাঁচা, ১ কেজি দুধে কতটুকু পানি মেশালে লাভ দ্বিগুন হয়, এ যদি পড়ে ও জেনে মানুষ হতে হয়, সেই মানুষ অন্যায়, দূর্নীতি করেই বাঁঁচবে, তাহলে আর মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ কি?
গলদটা কোথায় শাসকগোষ্ঠিও জানে। সমাজ, রাস্ট্রের রক্ষক, সুবিধাভুগিরা জেনে শুনে কেউ গোড়াতে হাত দিতে চায় না। কারন মানুষ যদি নীতি নৈতিকতা মুল্যবোধ ধারন করে, মেরুদন্ড শক্ত থাকে তবেই বিপদ।
এ বিপদের আপদ হচ্ছে সাধারন মানুষ, তাদেরকে যতোবেশী আত্মকেন্দ্রিকতায় ঠেলে দেয়া যায়, দলদাস, দলান্ধ বানানো ততোটাই সহজ। মানুষকে যতো বেশী বিভাজিত করা যায়, ততোই অন্যায় জুলুমের শাসনব্যবস্থাকে মজবুত ও দৃঢ় ভিত্তির ওপর রাখা যায়।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, শোষন বেড়েছে। অথচ কোথাও কোন শব্দ নেই। কি শান্ত পরিবেশ, তাই না!
মানুষ মরতে মরতে অপেক্ষায় থাকবে তাহেরির ঢেলে দেই চা.. এর মতন কেউ একজন বলবে, এসো রুখে দাঁড়াই, তখনো কি মানুষ নামবে?
মানুষকেই বিশ্বাস করতে হবে, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।
১৩৫ বার পড়া হয়েছে