রবীন্দ্রনাথের কবিতা: সৌন্দর্যে, নন্দনে

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ ৬:৩৭ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
শুদ্ধ সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে সত্তার নিরন্তর রূপপরিক্রমা রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রনাথের সকল কাজেই কম-বেশি লক্ষ্য করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, অনন্ত প্রেম ও সৌন্দর্যের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক রয়েছে। পত্রপুষ্পভরা ধরাতল থেকে গ্রহতারাভরা নীলাম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত সৌন্দর্য সরসীতে সৌন্দর্য-চলাচল পদ্যের মতো ফুটে উঠেছিলো নারী। অনন্ত প্রেম ও সৌন্দর্যকে কোনো বাস্তব নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে তার মাধুর্য যেমন থাকে না, তেমনি থাকে না রহস্যময়তাও। কেননা রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, নারীর সৌন্দর্য অনন্তসৌন্দর্যের অংশ বিশেষ।
রবীন্দ্র-কাব্যে আমরা লক্ষ্য করি যে, পৃথিবী ও কবি অখন্ড সত্তার যুগল বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এসেছে। মাটির বুকে তৃণের জেগে ওঠা, তরুলতার, গুল্মের নিগূঢ় জীবনরসধারা, কুসুম মুকুলের বৃন্তে বৃন্তে ফুটে ওঠা, আনন্দিত রৌদ্রপাল, ফুল গন্ধ, শ্যামস্নিগ্ধ ছায়া, মেঘেতে দিন জড়িয়ে থাকা, সাঁঝের আলো, দিঘির কালো জল ইত্যাকার সবকিছুতে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন নিজের বিস্তার। যেন ব্যক্তিগত উৎসব সংঘটিত হচ্ছে নিজের ভেতর। কবি লেখেনঃ
“ কলসী লয়ে কাঁখে পথ সে বাঁকা-
বামেতে মাঠ শুধু সদাই করে ধুধু
চাহিনে বাঁশবন হেলায় শাখা।
দিঘির কালো জলে, সাঁঝের আলো জ্বলে,
দু'ধারে ঘন ঘন ছায়ায় ঢাকা।
গভীর খির নীরে ভাসিয়া যাই ধীরে,
পিক কুহরে তীরে অমিয়মাখা।
পথে আসিতে ফিরে, আঁধার তরুশিরে।
সহসা দেখি চাঁদ আকাশে আঁকা।”
['বধূ', 'মানসী']
আগেই বলা হয়েছে যে, প্রেম ও সৌন্দর্যকে কোনো বাস্তব নারীর সঙ্গে সীমাবদ্ধ করলে তার মাধুর্য বজায় যেমন থাকে না, তেমনি থাকে না রহস্যময়তাও। নারীর সৌন্দর্য অনন্ত সৌন্দর্যের বাইরের কোনো ব্যাপার নয়। ভোগের দ্বারা সে সৌন্দর্য লাভ করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ লেখেনঃ
'নাই, নাই- কিছু নাই, শুধু অন্বেষণ
নীলিমা লইতে চাই আকাশ ছাঁকিয়া।
কাছে গেলে রূপ কোথা করে পলায়ন,
দেহ শুধু হাতে আসে-শ্রান্ত করে হিয়া।
প্রভাতে মলিন মুখে ফিরে যাই গেছে-
হৃদয়ের ধন কভু ধরা যায় দেহে ।
['হৃদয়ের ধন', 'মানসী’]
'মানসী' কাব্যে এসে কবির সঙ্গে একজন উচাঙ্গের শিল্পীর বস-বাস শুরু হয়েছে। এ কাব্যে এসে মর্ত্যের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ, মর্ত্যের শব্দ কবির মনোজগতে নতুন নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করে। যা কবির হৃদয়তরঙ্গে বিচিত্র ভাবানুভূতির সৃষ্টি করে। সে ভাবকেই কবি বাণীবন্দি করেছেন কবিতায়। এর মাধ্যমেই কবির মানসসুন্দরীর বহিঃ-প্রকাশ ঘটেছে। এ সর্ম্পকে কবির নিজের মত হচ্ছেঃ
"মানসী'তে যাকে খাড়া করেছি, সে মানসেই আছে; সে আর্টিস্টের হাতে রচিত ঈশ্বরের প্রথম অসম্পূর্ণ প্রতিমা। "
মানসেই আছে বৈকি! কবি'মানসী' কাব্যে সেই মানসীকে বাস্তবলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন এবং তিনি তা পেরেছেন। আর সে বাস্তব কেবল একটি জন্ম বা ইহজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং পূর্বজন্ম পরজন্ম পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। বস্তু ও স্রষ্টার মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান প্রতিষ্ঠিত না হলে বস্তু স্বরূপ প্রকাশ করে না বলেই রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। যে বস্তু সৌন্দর্য হতে পারে, প্রেম হতে পারে, আনন্দ হতে পারে। বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের একটি যথাযথ মূর্তিদানের উদ্দেশ্যে কবি 'মানসী'কে আবিষ্কার করেছেন। এই ‘মানসী ' কবির মনের সৌন্দর্যের প্রতীক। আর তাই মানসীর সঙ্গে সৌন্দর্যের, মাধুর্যের, রহস্যের ব্যাপার জড়িত।
'মানসী' কাব্যের বিভিন্ন কবিতার মধ্যে ভাবের ও রূপের মিল লক্ষ্য করা যায়। যদিও 'মানসী' কাব্যে এসে কবির ভাবজগত নতুনত্বের সন্ধান করেছ; তবুও পূর্ববর্তী কাজের অনুপ্রেরণা একেবারেই নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। পূর্ববর্তী কাব্যসমূহের জের ‘মানসী' কাব্যে এসে বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে এবং নতুন গন্তব্যের পথিক হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, মানুষের শিয়রে এসে শান্তি ও সান্ত্বনার মতো জেগে রয়েছেন প্রকৃতিদেবী। এই প্রকৃতি মমতা দিসে প্রশমিত করে মানুষের সব জ্বালা-যন্ত্রণা। প্রকৃতিদেবী তার সৌন্দর্য। শুশ্রূষা দিয়ে যেন মানুষের সব ক্ষয়-ক্ষতি পূরণ করে দিচ্ছেন। এ ধারণা রবীন্দ্রনাথের যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো ওয়ার্ডসওয়ার্থের। প্রকৃতিপ্রেমের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওয়ার্ডসওয়ান্সের জীবনদর্শনের সমীপবর্তিতা সহজেই লক্ষ্য করা যায়।
'বস্তু ও স্রষ্টার মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান প্রতিষ্ঠিত না হলে বস্তু স্বরূপ-প্রকাশ করে না রবীন্দ্রনাথের চোখে। সে বস্তু সৌন্দর্য হতে পারে, প্রেম হতে পারে, আনন্দ হতে পারে। বিশুদ্ধ সৌন্দর্যকে একটি যথাযোগ্য মূর্তিদানের উদ্দেশ্যে কবি 'মানসী'কে আবিষ্কার করেছেন। এই মানসী কবির মনের সৌন্দর্যের প্রতীক। আর তাই মানসীর সঙ্গে সৌন্দর্যের মাধুর্যের, রসরহস্যের ব্যাপার জড়িত। 'মানসী' কাব্যকে কবির একাধিক কাব্যের সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। 'মানসী' কাব্যের বিভিন্ন কবিতার মধ্যে ভাবের ও রূপের মিল লক্ষ্য করা যায়। যদিও 'মানসী' কাব্যে এসে কবির ভাবজগতের নতুনত্ব সহজেই সন্ধান করা সম্ভব। তবে 'মানসী' কাব্যে পূর্ববর্তী কাজের অনুপ্রেরণা একেবারে নিঃশেষিত হয়ে যায়নি।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, মানুষের শিয়রে শান্তি ও সান্ত্বনার মতো জেগে রয়েছেন প্রকৃতিদেবী। এই প্রকৃতি মমতা দিয়ে প্রশমিত করে মানুষের সব জ্বালা-যন্ত্রণা। প্রকৃতিদেবী তাঁর সৌন্দর্য ও শুশ্রূষা দিয়ে যেন মানুষের সব ক্ষয়-ক্ষতি পূরণ করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এই এই দুই কবির মধ্যেই ছিলো এক ধরনের ধ্যানদৃষ্টি; যা প্রকৃতির মর্মস্থল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। 'মানসী' কাব্যেও রবীন্দ্রনাথের এই বৈশিষ্ট্য সত্য হয়ে উঠছে। প্রকৃতিপটে স্থাপিত মানুষকে রবীন্দ্রনাথ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন। কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তাই উচ্চারণ করেনঃ
“প্রথম মধ্যাহ্নতাপে প্রান্তর ব্যাপিয়া কাঁপে
বাষ্প শিখা অনলশ্বসনা,
অম্বেষিয়া দশ-দিশা যেন ধরণীর তৃষা
মেলিয়াছে লেলিহা রসনা।
ছায়া মেলি সারি সারি স্তব্ধ আছে তিন চারি
শিশুগাছ পাণ্ডুকিশলয়,
নিমবৃক্ষ ঘনশাখা গুচ্ছ গুচ্ছ পুষ্পে ঢাকা-
আম্রবন তাম্রফলময়।
গোলক-চাঁপার ফুলে গন্ধের হিল্লোল তুলে,
বন হতে আসে বাতায়নে।"
['কুহুধ্বনি', 'মানসী']
'মানসী' কাব্যে প্রকৃতিদৃশ্যের এমন ঘনপ্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়। আর তাই মানসীকে, প্রিয়াকে কবির মনে হয় প্রকৃতির মর্মর্জাতিকা। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে প্রকৃতি ছিলো অস্তিত্বের অস্তিত্ব, জীবনের জীবন।
প্রকৃতি তাঁর কাব্যে মনে হয়েছে স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও স্বনির্ভর। ‘ Wordsworth sees nature as not merely living its own life but full of full of beauty and joy." [The Romantic Imagination: C. M. Bowra]
রবীন্দ্রনাথও প্রকৃতির সূক্ষ্ম বিবর্তনশীল মুখশ্রী লক্ষ্য করে যুগপৎ ধ্যান ও আনন্দ লাভ করেছিলেন। প্রকৃতি তাঁর কাছে সুন্দর, কবিতা লেখার প্রেরণা।
'কড়ি ও কোমল' কাব্যে যে প্রকৃতি চেতনা নারীর সৌন্দর্যের উপস্থাপনা প্রেমের ও ধ্যানের উন্মেষ ঘটিয়ে ছিলো, তারই বিকশিত রূপ ‘মানসী' কাব্যের বিভিন্ন কবিতা। এখানে প্রেম ও প্রকৃতি, নারী ও প্রকৃতি এক এবং একাকার হয়ে গিয়েছে। জানা গেছে যে, 'মানসী' কাব্যের অধিকাংশ কবিতা পশ্চিমের এক শহরের নির্জন বাংলো ঘরে লিখিত হয়েছিলো। 'মানসী' কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন:
‘আমার কল্পনার উপর নতুন পরিবেষ্টনের প্রভাব বার বার দেখেছি, এই জন্যই আলমোড়ায় যখন ছিলুম, আমার লেখনী হঠাৎ নতুন পথ নিলো ‘শিশুর’ কবিতায় । অথচ সে জাতীয় কতিপয় কোন উপলক্ষই সেখানে ছিল না। পূর্বতন রচনাধারা থেকে স্বতন্ত্র এ একটা নূতন কাব্যরূপের প্রকাশ 'মানসী' ও সেই রকম। নূতন আবেষ্টনে ও এই কবিতাগুলি সহসা যেন ধ্যান ধারণ করল। পূর্ববর্তী 'কড়ি ও কোমল' এর সঙ্গে এর বিশেষ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি। মানসীতে ছন্দের নানা খেয়াল দেখা দিতে আরম্ভ করেছে। কবির সঙ্গে যেন একজন শিল্পী এসে যোগ দিল।
['মানসী’; সূচনা ২/ ১১৫-১১৬]
ওয়ার্ডসওয়ার্সের কাব্যের মতোই রবীন্দ্রনাথের কাব্যে মৃৎপ্রকৃতিকে ভালোবাসার অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। মাটির পৃথিবীকে ভালোবাসার অনেক পরিচয় 'মানসী' কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় নিহিত রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির নির্জন রুপের সান্নিধ্যে এসে এক শান্ত সমাহিত তপস্বীতুল্য আত্মার আবিষ্কার করেন নিজেরই ব্যক্তিত্বের ভিতরে।
'মানসী' কাব্যে (১৮৯০) কবিচেতনার এক অভূতপূর্ব বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। কাব্যসৃষ্টির মৌলিকতা, শিল্পরূপ এবং চৈতন্যের গভীর উপলব্ধি বিবেচনা করলে ‘মানসী' পূর্ববর্তী কাব্যগুলো থেকে অগ্রসর। কবি-প্রতিভার স্মারক হিসেবে 'মানসী' অসাধারণ তাৎপর্যমণ্ডিত। 'কড়ি ও কোমল' কাব্যে রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্ত পার্থিব চেতনার উত্তাপের মধ্যে শান্তি পাচ্ছিল না ।'মানসী' কাব্যেও এ ধরনের আশান্তি, দ্বিধা ও সংশয় ঘনায়িত হতে দেখা যায়। 'মানসী' কাব্যে দুটি প্রধান সুর ধ্বনিত হয়েছে। এর একটি হচ্ছে প্রেম, অন্যটি হচ্ছে প্রকৃতি ও সৌন্দর্যচেতনা। 'মানসী' কাব্যের এই দুটি সুরের মধ্যেই পার্থিব চেতনার উত্তাপ অনুভব করা যায়।
আর এই দু'টি সুরেই দ্বিধা ও সংশয় ঘনীভূত হতে দেখা যায়। দেহ ও আত্মার অন্বয় সম্পর্ক সম্বন্ধে পূর্ণচেতনার সাক্ষাৎ তখনো তিনি লাভ করতে সক্ষম হননি। 'মানসী'তে এসেও প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেহচেতনার অঙ্গীভূত করে দেখেছিলেন। এবং সেজন্যই তাঁর মানসিক বিক্ষোভ, ক্ষেত্র বিশেষে অশান্তিও দানা বেঁধেছে। কবি নিজেই মনে করতেন যে, বাসনার উত্তাপে প্রেমকে পাওয়া সম্ভব নয়। আর তাই তিনি লেখেনঃ
‘নিভাও বাসনা-বহ্নি নয়নের নীরে।’ রবীন্দ্রনাথের মানবিক হৃদয় 'মানসী' নামক স্বপ্নপ্রতিমার আনুকূল্য লাভের জন্যেই সক্রিয় ছিলো। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা দেখতে পাই যে, জীবনে কিছুই হারিয়ে যায় না। যে প্রকৃতি সৌন্দর্যমন্ত্রে কবিকে দীক্ষা দিয়েছিলো, সে চলে গিয়েছে আবার নতুন রূপে আসবে বলে।
প্রকৃতির ভেতর কবি গৌরবের সন্ধান পেয়েছেন। কবি এ-ও অনুভব করেন যে, আনন্দের যা কিছু, তা কখনো চিরতরে ধ্বংস করতে পারবে না কেউ। তিনি এ-ও মনে করতেন যে, সত্য ও সুন্দরকে চিরতরে ধ্বংস করতে পারবে না কেউ। আর সত্য, সুন্দর, কল্যাণ, আনন্দ একই সুরে গাঁথা। আত্মা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রূপসাগরের দর্শন ও বার্তা পাঠায়।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতন যে, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-কোমলতা প্রকৃতিসুন্দুরীর নিরন্তর সহবাসেই আরম্ভ হয়। 'মানসী' কাব্যে মানসীর রূপের মধ্যে মানসী ও প্রকৃতির এক অবিমিশ্র আদান-প্রদান লক্ষ্য করা যায়। প্রিয়তমার রূপবয়ব রচিত হয়েছে প্রকৃতির উদার সৌন্দর্য চয়ন করে। মানবীর রূপকল্প দিয়েই প্রকৃতির রূপনির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। 'মানসী' কাব্যে প্রকৃতির রূপসৌন্দর্যে কবির মানসসুন্দরীর রূপসৌন্দর্য চিরদিনের মতো একাকার হয়ে গেছে। কবি তাই লেখেনঃ
'শত শত প্রেমপাশে টানিয়া হৃদয়
একি খেলা তোর।
ক্ষুদ্র ও কোমল প্রাণ, ইহারে বাঁধিতে
কেন এত ডোর।
ঘুরে ফিরে পলে পলে
ভালোবাসা নিস ছলে,
ভালো না বাসিতে চাস
হায় মনচোর।
হৃদয় কোথায় তোর খুঁজিয়া বেড়াই
নিষ্ঠুর প্রকৃতি।
এত ফুল, এত আলো, এত গন্ধগান,
কোথায় পিরিতি।
আপন রূপের রাশে
আপনি লুকায়ে হাসে,
আমরা কাঁদিয়া মরি
এ কেমন রীতি।'
[‘প্রকৃতির প্রতি', 'মানসী']
আগেই বলা হয়েছে যে, 'মানসী' কাব্যে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে নারীরূপে কল্পনা করেছেন, জীবন্তসত্তারূপে কল্পনা করেছেন। পৃথিবীর মাটি ও তৃণে, পত্রেপুষ্পে বর্ণে -গন্ধে -রূপে-রসে এক জ্যোতিময়ীর অধিবসতি লক্ষ্য করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক কল্পনার এক সেরা ব্যবহারকারী কবি। আর তাই কবি প্রকৃতিকে প্রিয়া বলে কল্পনা করতে পারেন। প্রিয়া ও প্রকৃতি যেন রবীন্দ্রনাথের কাছে একই সত্তার এপিঠ ওপিঠ। 'মানসী' কাব্যের একটি কবিতার নাম 'অহল্যা'। এই অহল্যা প্রকৃতপক্ষে নিখিলের অন্তরের কাছে বসে থাকা রূপবতী প্রকৃতিরই মরমী প্রতিমা। অভিশপ্ত প্রস্তর হয়েও সে আসলে এ জননী বসুন্ধরারই মাটির কন্যা ছিলো। আর তাই ভেষজ পৃথিবীর প্রেমে অভিভূত কবিসত্তার ভারসরোবরে ডুব দিয়ে তার সহজ জাগরণ নিছক কবিপ্রাণের বিলাসিতা নয়,তাকে বলতে পারি রোমান্টিক আত্মপোলব্ধিরই অনিবার্য এক উপকরণ।
রবীন্দ্রনাথ লেখেনঃ
‘দিলে আজি দেখা
ধরিত্রীর মনোজাত কুমারীর মতো
সুন্দর সরল শুভ্র।
হয়ে বাক্য হত
চেয়ে আছে প্রভাতের কপোতের পানে।
যে শিশির পড়েছিল তোমার পাষাণে
রাত্রিবেলা, এখনো সে কাঁপিছে উল্লাসে
আজানুচম্বিত, মুক্ত কৃষ্ণ কেশপাশে,
যে শৈবাল রেখেছিল ডাকিয়া তোমায়
ধরণীর শ্যামশোভা অন্তরের প্রায়
বহুবর্ণ হতে, পেয়ে বহু বর্ষাধারা
সতেজ সরস ঘন, এখনো তাহারা
লগ্ন হয়ে আছে তব নগ্ন গৌরদেহে
মাতৃদত্ত বস্ত্রখানি সুকুমার স্নেহে।’
['অহল্যা', 'মানসী]
'মানসী' কাব্যে পৃথিবী ও কবি অখণ্ড সত্তার যুগল বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এসেছে। মাটির বুকে তৃণের জেগে ওঠা, তরুলতাগুল্মের নিগূঢ় জীবনরসধারা, কুসুম মুকুলের বৃন্তে বৃন্তে ফুটে ওঠা, আনন্দিত রৌদ্রপাল, ফুলগন্ধ, শ্যামস্নিগ্ধ ছায়া, মেঘেতে দিন জড়িয়ে রাখা, সাঁঝের আলো, দিঘির কালো জল ইত্যাকার সবকিছুতে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন নিজের বিস্তার- যেন ব্যক্তিগত উৎসব সংঘটিত হচ্ছে নিজের ভিতরঃ
'কলসী লয়ে কাঁখে পথ সে বাঁকা-
বামেতে মাঠ শুধু সদাই করে ধুধু,
ডাহিনে বাঁশবন হেলায় শাখা।
দিঘির কালো জলে, সাঁঝের আলো জ্বলে,
দুধারে ঘন ঘন ছায়ায় ঢাকা।
পিক কুহরে তীরে অমিয়মাখা।
পথে আসিতে ফিরে, আঁধার তরুশিরে।
সহসা দেখি চাঁদ আকাশে আঁকা।’’
[বধূ', 'মানসী' ]
শুদ্ধ সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে সত্তার রূপপরিক্রমা অঙ্কন রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য 'মানসী' কাব্যে স্পষ্ট রূপে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। কীটসের মতো রবীন্দ্রনাথের কাছেও সুন্দর চিরদিনের আনন্দের বিষয়। এই রূপমাধুরী ক্রমাগত বেড়ে চলে, কখনো ফুরায় না। কেবল রচনা করে রাখে মানুষের জন্যে এক শান্তির কুঞ্জ, আমাদের মধুর স্বপ্ন দেখা ঘুমে এই সুন্দর বারবার ফিরে আসে। রবীন্দ্রনাথ মনে করছেন যে, অনন্ত প্রেম ও সৌন্দর্যের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক রয়েছে। পত্রপুষ্পভরা ধরাতল থেকে গ্রহতারাভরা নীলাম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত সৌন্দর্য সরসীতে সৌন্দর্য চলাচলের মধ্যে পদ্মের মতো ফুটে উঠেছিলো নারী। অনন্ত প্রেম ও সৌন্দর্যকে কোনো বাস্তব নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে তার মাধুর্য যেমন থাকে না, তেমনি থাকে না রহস্যময়তাও। কেননা রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, নারীর সৌন্দর্য অনন্ত সৌন্দর্যের অংশবিশেষ।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং সহকারী অধ্যাপক, বাংলা, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা।
১৮২ বার পড়া হয়েছে