জন্মশতবর্ষেও অযত্নে ধ্বংসপ্রায় ইলা মিত্রের পৈতৃক ভিটা

শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ ৬:৫৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
নাচোল কৃষক বিদ্রোহের কিংবদন্তি নেত্রী ইলা মিত্রের জন্মশতবর্ষে (১৮ অক্টোবর ২০২৫) তার স্মৃতিবিজড়িত শৈলকুপার পৈতৃক বাড়িটি পড়ে আছে অবহেলা আর অযত্নে।
সরকারি গেজেটে প্রত্নসম্পদ ঘোষণার নয় বছর পেরিয়ে গেলেও দখলমুক্ত হয়নি ঐতিহাসিক এই ভবন। স্থানীয় প্রশাসনের নিরব ভূমিকা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামের রায়পাড়ায় অবস্থিত বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন ইলা মিত্রের ঠাকুরদাদা রাজমোহন সেন, ১৮৯৯ সালে। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ভবনটি ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ২২ শতক জমিসহ প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষিত হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
পুরোনো চুন-সুড়কির গাঁথুনিতে নির্মিত দোতলা ও একতলা মিলিয়ে মোট ৯ কক্ষবিশিষ্ট ভবনটি বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ছাদের অংশবিশেষ ধসে পড়েছে, দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল। বাড়ির সঙ্গে থাকা পুকুর ও শানবাঁধানো ঘাটও অযত্নে বিলীন হতে বসেছে।
বর্তমানে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন হাজী কিয়াম উদ্দিনের উত্তরসূরীরা। তারা দাবি করছেন, জনৈক খোদাবক্সের কাছ থেকে ১৯৭০ সালের দিকে তারা এই সম্পত্তি ক্রয় করেছেন এবং দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করছেন। প্রতি বছরই প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুনর্বাসনের আশ্বাস মিললেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন আবু বকর নামে বর্তমান এক বাসিন্দা।
প্রায় ৯ বছর আগে গেজেট প্রকাশের পরও বাড়িটি দখলমুক্ত করতে পারেনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এমনকি একটি সাইনবোর্ড টানানোর মতো প্রাথমিক উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল জানান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। তবে জমি অধিগ্রহণ কিংবা পুনর্বাসনের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা এখনও পাওয়া যায়নি।
শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্নিগ্ধা দাস বলেন, “বর্তমান বাসিন্দারা নিজেদের মালিক দাবি করছেন। জমি অধিগ্রহণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ছাড়া পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়।”
১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু হয়ে ২০১১ সাল থেকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে বেগবান হয় পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণ আন্দোলন। পরে এই আন্দোলনে যুক্ত হয় উদীচী, ক্ষেতমজুর সমিতি, সিপিবি, কৃষক সমিতিসহ নানা প্রগতিশীল সংগঠন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশ হলেও এখনও বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
কমরেড ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক সুজন বিপ্লব বলেন, “সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশের পরেও বাড়িটি দখলমুক্ত না হওয়া চরম অবহেলার উদাহরণ। এই বাড়ির সঙ্গে জড়িত একটি সংগ্রামী ইতিহাস, এটি হারিয়ে গেলে প্রজন্ম ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে।”
ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করলেও তার শৈশব কেটেছে ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তেভাগা ও নাচোল কৃষক বিদ্রোহে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জনগণের ‘নাচোলের রানিমা’। কৃষকদের ভূমির অধিকারের পক্ষে সংগ্রাম করে তিনি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরে একাধিকবার বাংলাদেশে এসে তিনি তার পৈতৃক ভিটা দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যশোরে এক অনুষ্ঠানে তাকে পৈতৃক ভিটার মাটি উপহার দেওয়া হয়, যা তিনি শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করেন।
স্থানীয়দের দাবি, দ্রুত জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে দখলদারদের পুনর্বাসন করে ইলা মিত্রের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করা হোক। তার নামে মিউজিয়াম, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিও জোরালো হয়েছে।
সিপিবি ঝিনাইদহ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড আবু তোয়াব অপু বলেন, “একজন কৃষকের অধিকারের জন্য জীবন বাজি রেখে লড়েছেন যিনি, আজ তিনি নিজেই তার পৈতৃক ভূমি থেকে বঞ্চিত। এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।”
১১১ বার পড়া হয়েছে