দেশের বৈদেশিক ঋণ: তিন মাসেই বেড়েছে ৭ বিলিয়ন ডলার

শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৮:০০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আবারও রেকর্ড ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন—এই তিন মাসে বাংলাদেশ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছে, যার প্রায় পুরোটা সরকারি খাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
এর ফলে গত জুন শেষে বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, গত মার্চ পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। তার তিন মাসের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়নে। আর গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় এই ঋণ বেড়েছে ৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার।
সরকার এই ঋণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), জাইকা, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) সহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে।
রিজার্ভে স্থিতিশীলতা, তবুও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে
গত এক-দেড় বছর ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতনে ছিল। আমদানি ব্যয় বেশি ও রেমিট্যান্সে ধীরগতির কারণে দেশে ডলারের সংকট দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রণোদনা সহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়।
বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে রিজার্ভ পরিস্থিতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক ঋণ পাওয়ায় রিজার্ভ ও ডলারের বিনিময় হারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, স্থিতিশীল বিনিময় হার ও রিজার্ভ পরিস্থিতি বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি কিছুটা কমিয়েছে। তবে তারা হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে পরিশোধে চাপ বাড়বে।
সরকারি ঋণের পরিমাণ বেশি, বেসরকারি খাতে হ্রাস
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, জুন শেষে সরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা মার্চে ছিল ৮৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন। অর্থাৎ তিন মাসে সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, একই সময়ে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি কমে ১৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের তিন মাসে ছিল ১৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন। এই খাতে স্বল্পমেয়াদি কিছু ঋণ বাড়লেও মোট পরিশোধের পরিমাণ বেশি হওয়ায় স্থিতি কমেছে।
বিশ্লেষকদের মতামত: ঋণ যেন না হয় বোঝা
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “বিদেশি ঋণের যথাযথ ব্যবহারের ওপরই নির্ভর করবে এটি আর্শীবাদ হবে না অভিশাপ। যদি অপচয় বন্ধ না হয়, তাহলে ঋণ বোঝায় পরিণত হবে।”
তিনি আরও জানান, জিডিপি অনুপাতে বর্তমানে ঋণ এখনো সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও বৈদেশিক আয়ের তুলনায় সুদ ও কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়ছে। “সবকিছু মিলিয়ে এখন স্বস্তির হলেও ভবিষ্যতে পরিশোধের সময় ঘাম ঝরবে,”—মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, “দেশি উৎসের চেয়ে এখন বিদেশি ঋণের সুদের হার তুলনামূলক কম হওয়ায় বেসরকারি উদ্যোক্তারাও আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে যাদের বৈদেশিক আয় নেই, তাদের এ ঋণ না দেওয়াই উত্তম।”
দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রবণতার চিত্র
২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় দেশে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা কম। ২০০৮ সালের শেষে তা দাঁড়ায় ২১ বিলিয়নে। এরপর আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
বিদেশি ঋণের বর্তমান প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একদিকে যেমন বড় আকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি করছে, অন্যদিকে তা ভবিষ্যতের জন্য চাপের কারণও হতে পারে। এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো—এই ঋণের সর্বোচ্চ কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সময়মতো পরিশোধ সক্ষমতা ধরে রাখা।
১০৮ বার পড়া হয়েছে