৩ মাস পর উন্মুক্ত সুন্দরবন, জেলেপল্লি ও পর্যটনখাতে ফিরছে কর্মচাঞ্চল্য

সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২:৫০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
দীর্ঘ তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে আজ সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি মিলছে। ফলে উপকূলজুড়ে বনজীবী ও পর্যটন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। আবারও কর্মমুখর হয়ে উঠেছে সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, নীলডুমুরসহ সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলো।
সুন্দরবন কেন্দ্রিক জীবিকা-নির্ভর জেলে, বাওয়ালি ও ট্রলার মালিকদের মাঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রস্তুত হয়ে উঠেছে শতাধিক পর্যটন ট্রলার, নতুন রঙে রাঙানো হয়েছে বেশ কিছু নৌযানও। নানা নতুন প্যাকেজ ও সেবা নিয়ে প্রস্তুত পর্যটন উদ্যোক্তারাও।
বন বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস মাছ ও কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম হওয়ায় সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরা ও পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকে। চলতি বছর সেই সময়সীমা এক মাস এগিয়ে এনে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয় সুন্দরবন।
আবার রুজির সন্ধানে বনজীবীরা
টানা তিন মাস নিষিদ্ধ থাকায় অনেক বনজীবী ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। জেলে জাহাঙ্গীর সানা বলেন, “মাছ ধরা বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে সুদের টাকা ধার নিতে হয়েছে। এখন বনে গিয়ে ভালো আহরণ করতে পারলে এই বোঝা কিছুটা কমবে।”
ট্রলার মালিক নূর ইসলাম জানান, তার ট্রলারটি তিন মাস পড়ে থাকার ফলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ঋণ নিয়ে ট্রলার মেরামত করতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
বনজীবী ইউনুস বলেন, “সুন্দরবন খুলে গেছে শুনে এখন একটু স্বস্তি পাচ্ছি। এখন যদি ভালো মাছ পাই, তাহলে সংসার চালানো কিছুটা সহজ হবে।”
পর্যটনে নতুন আশা
নিষেধাজ্ঞা শেষে পর্যটকদের জন্যও খুলে দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন। ট্রলার মালিক জয়নাল আবেদীন জানান, সাতক্ষীরা রেঞ্জে প্রায় ১০০ পর্যটন ট্রলার রয়েছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে অনেকেই ট্রলার সাজিয়েছেন নতুন করে। পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে পর্যটন প্যাকেজেও এসেছে পরিবর্তন।
বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জের ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি খোদা বক্স গাজী বলেন, “পাঁচ শতাধিক ট্রলার পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। তিন মাস বন্ধ থাকায় চালক ও শ্রমিকরা কঠিন সময় পার করেছেন। এখন সুন্দরবন খুলে দেওয়ায় আশার আলো দেখছি।”
বনবিভাগের প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসি এফ) ফজলুর রহমান জানান, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর এই সময়কালে বন বন্ধ রাখা হয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশনে ২,৯৭০টি পাস নবায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “বনজীবী ও পর্যটকদের সুষ্ঠুভাবে বনভ্রমণে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত। নিরাপত্তা, গাইডলাইন ও পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধিতে কাজ করছি। নতুনভাবে সাজানো হয়েছে কলাগাছিয়া এলাকা ও করমজলে সংযুক্ত করা হয়েছে আরও তিনটি কুমির।”
উন্মুক্ত বনাঞ্চলের দাবি
জেলেদের একাংশের অভিযোগ, বনের ৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য ঘোষিত হওয়ায় খোলা জায়গায় দুই-তিন হাজার জেলে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ করেন, ফলে সবার জন্য পর্যাপ্ত আহরণ সম্ভব হয় না। তারা দাবি করছেন, কিছু অংশ উন্মুক্ত করে তাদের জন্য আরও সুযোগ তৈরি করা হোক।
তবে অভিযোগ রয়েছে, নিষেধাজ্ঞা চলাকালে কিছু অসাধু চক্র সুযোগ নিয়ে বনের ভেতরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও হরিণ নিধন চালায়। বন বিভাগের নজরদারি আরও জোরদারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সুন্দরবন শুধু একটি বন নয়, এটি হাজারো মানুষের জীবিকার উৎস এবং পর্যটনের এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার। তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে বনজীবী ও পর্যটনখাতে যুক্ত মানুষের মুখে ফিরেছে হাসি। এখন প্রয়োজন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, দায়িত্বশীল আচরণ ও পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে এই ঐতিহ্য ও জীবিকার স্থায়ী সংরক্ষণ।
১৪৬ বার পড়া হয়েছে