দারিদ্র্য ও ধর্মীয় আগ্রহে কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ছে দ্রুতগতিতে

সোমবার, ৭ জুলাই, ২০২৫ ৭:১৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দ্রুততম বর্ধনশীল ধারায় পরিণত হয়েছে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা। দারিদ্র্য, ধর্মীয় অনুরাগ এবং সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনীহার কারণে প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য হারে শিক্ষার্থী বাড়ছে এসব মাদ্রাসায়।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই ধারাকে সরকারি নীতিমালার আওতায় আনতে জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশে মূলধারার মাদ্রাসা দু’ধরনের—আলিয়া ও কওমি। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন আলিয়া মাদ্রাসার বিপরীতে কওমি মাদ্রাসাগুলো চলে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাক্রম, মনিটরিং বা শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান বিষয়ে সরকারের কাছে নেই সুস্পষ্ট তথ্য।
তিন বছরে বেফাকের পরীক্ষার্থী বেড়েছে ৫৫%
বর্তমানে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ছয়টি বড় বোর্ড এবং কিছু ছোট বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ (বেফাক)। বেফাকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নেয় ২ লাখ ২৫ হাজার ৬৩১ শিক্ষার্থী। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৬ জনে। অর্থাৎ তিন বছরে পরীক্ষার্থী বেড়েছে ৫৫ শতাংশ।
এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বেফাকের অধীনে বর্তমানে দেশে প্রায় ২৯ হাজার মাদ্রাসা রয়েছে এবং শিক্ষার্থী প্রায় ৫০ লাখ। এবার কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১৭ হাজার ৩৬২টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী।
সাধারণ শিক্ষায় বিপরীত চিত্র
অন্যদিকে, সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর হার দিন দিন কমছে। ২০২২ সালে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৩ শিক্ষার্থী। কিন্তু ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ জন। দুই বছরে ঝরে পড়ে ৫ লাখ ৩৪ হাজার শিক্ষার্থী, যা মোট শিক্ষার্থীর ২৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।
প্রাথমিক পর্যায়েও কমছে শিক্ষার্থী। ২০২৩ সালের প্রাথমিক শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২২ সালের তুলনায় শিক্ষার্থী কমেছে ১০ লাখেরও বেশি।
দারিদ্র্য ও ধর্মীয় চিন্তা প্রধান কারণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘‘দারিদ্র্য, ধর্মীয় আগ্রহ ও আবাসিক সুবিধা কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বৃদ্ধির প্রধান কারণ। সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়ানো খরচসাপেক্ষ হওয়ায় দরিদ্র পরিবারগুলো কওমি মাদ্রাসাকেই বেছে নিচ্ছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘শিক্ষাক্রমে ঘনঘন পরিবর্তন, করোনার সময়ে সাধারণ স্কুল বন্ধ থাকলেও কওমি মাদ্রাসা চালু থাকায় অভিভাবকদের আস্থা বেড়েছে।’’
সরকারি মনিটরিংয়ের বাইরে কওমি মাদ্রাসা
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার মান উন্নয়নে জরুরি একটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, ‘‘এ শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘কওমি মাদ্রাসা নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা জীবিকার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে।’’
স্বীকৃতি পেয়েও পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগছে না
সরকার দাওরায়ে হাদিস সনদকে মাস্টার্স সমতুল্য স্বীকৃতি দিলেও বাস্তবে কওমি শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এখনও সীমিত। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘‘স্বীকৃতির মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তবে উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানে কওমি গ্র্যাজুয়েটদের অংশগ্রহণ এখনও আশানুরূপ নয়।’’
শহরাঞ্চলেও বাড়ছে কওমির প্রসার
রাজধানীসহ শহরাঞ্চলের নিম্নআয়ের পরিবারগুলোও সন্তানদের কওমি মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন। অনেক মাদ্রাসা চলছে ভাড়া বাসার ফ্ল্যাটে। অভিভাবকরা জানান, কম খরচ ও আবাসিক সুযোগই তাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে।
বোর্ডগুলোতেও বাড়ছে শিক্ষার্থী
সিলেটভিত্তিক বোর্ড ‘আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তালিম’-এর মহাসচিব মাওলানা আবদুল বছির জানান, তাদের অধীনে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার, শিক্ষক ১১ হাজারের বেশি। হবিগঞ্জ বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আবু সালেহ জানান, ‘ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠদানে কওমি মাদ্রাসার মান এখন অনেক উন্নত।’
নীতিমালার আওতায় আনার তাগিদ
শিক্ষাবিদদের মতে, কওমি ধারাকে উন্নত ও সমন্বিত করতে হলে সরকারি তত্ত্বাবধান, পরিসংখ্যান ও নীতিমালার আওতায় আনা জরুরি। তারা মনে করছেন, বর্তমান সরকার এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজবে।
১১৪ বার পড়া হয়েছে